বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

একজন সৎ পাগল অথবা অতিবন্ধুর গল্প



একজন সৎ পাগল অথবা অতিবন্ধুর গল্প 
..............................................................
পাগল ই তো...সে পাগল নয় তো কি !! পাগলটা হুট করেই না বলে চলে গেল না ফেরার দেশে। বরাবরের মতই।
অত্যন্ত সুদর্শন সদাহাস্যময় এক মায়াবী চেহারার যুবক। সদা কর্মচঞ্চল। অসম্ভব মেধার অধিকারী। কোনদিন কেউ তার মুখ কালো দেখিনি। যে যখন যে কাজে ডাকতো, কোন বিপদে পড়ে ডাকলেই তখনিই তার কাছে ছুটে যেত। প্রাইমারী স্কুল থেকে একসাথে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিজীবনেও একসাথে আমরা। আজ থেকে শুধু পার্থিব ভাবে আলাদা হয়ে গেলাম।
স্কুলে যখন পড়তো লাল টুকটুকে এক খান বাবু ছিল দেখতে। কলেজে আমরা তাকে ডাকতাম টাইটানিক রাসেল (ডি কাপ্রিও এর মত চুল ছিল) বলে। মেয়েদের মত লাজুক ছিল, কিন্তু বাঘের মত সাহস ছিল। ভয় বলে কিছু দেখিনি ওর ভিতর। কোন মেয়ে দেখলেই ওর চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যেত। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো ছোটবেলা থেকেই। প্রাইমারী স্কুলে, হাইস্কুল, কলেজে ক্লাস ক্যাপ্টেন ও ফার্স্টবয়, মেট্রিকে সেন্টার ফার্স্ট, কলেজে সেই একই রেজাল্ট, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া, কিন্তু ভর্তি হয়েছিল খুলনা বি,আই,টি তে। ওখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি,পি। রেজাল্টও খুব ভাল। অবশেষে টেলিকম কোম্পানিতে চাকরি। এর কয়েক বছর যেতে না যেতেই চাকরি ছেড়ে ব্যাবসায় নামা, কারন কেউ তার সাথে চাকরের মত ব্যাবহার করুক এটা সহ্য হয়নি।
আমাদের একটা ফাউন্ডেশন আছে, নাম বন্ধন ৯৭ ফাউন্ডেশন। আমরা যারা চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে ৯৭ সালে এস,এস,সি পরিক্ষা দিয়েছিলাম এটা তাদের সংগঠন। ওই সংগঠনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিল সে। আমরা কলেজ পাশ করার আগেই বাংলাদেশের অর্ধেক ঘুরে শেষ করে ফেলেছিলাম ১০-১১ জন মিলে। সে ছিল সেই সব আয়োজনের মধ্যমনি। সব কাজ নিজে থেকে করতো। জন্মগত ভাবে সহজাত লিডারশীপ ছিল ওর ভিতর। ওর প্লানে একটানা ৭ দিন পরপর রাত জেগে পিকনিকও করেছি। কেয়ারটেকার সরকারের সময় যখন সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল সেই সময়ও তার নেতৃতে সারারাত জেগে পিকনিক করেছি আমাদের চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত চাঁদমারি মাঠে।
কখনও অন্যায় করতে দেখিনি, কিন্তু অন্যায় দেখলে সাথে সাথে রুখে দাড়াতে দেখেছি। কোথাও বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিলে চা-নাস্তার বিলটা ওই বেশিরভাগ সময় দিত। তার মানে এই নয় যে ওর অনেক টাকা ছিল, কিন্তু ওর মনটা ছিল বিশাল বড়। ওর মত স্বার্থপরহীন মানুষ আমি দুইটা দেখিনি। সবার জন্যই ও ছিল দরাজ দিল। আর বন্ধুত্তের জন্য ছিল পাগলের থেকেও বড় পাগল। ৩ যুগের এই স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পেয়েছি ওর কাছ থেকে আমরা সবাই। ওর কোন শত্রু ছিলনা। দলমত নির্বিশেষে সবাই ওকে ভালবাসত। কি যে পাগলামি করতো বন্ধুদের জন্য! তাই বন্ধুরাও ওর জন্য ছিল পাগল। আমাদের সংগঠনের সব কাজের সবসময়ের জন্য অর্থ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের জন্য ও ছিল অটোমেটিক চয়েজ। সৎ এর সর্বচ্চো উদাহারন ছিল ও। যে কোন প্রোগ্রাম এর পর যখন টাকায় শর্ট পড়তো, তখন বাকি টাকাটা ওই ম্যানেজ করে দিত। এত কস্ট করতো আমাদেরকে হাসিখুশি রাখার জন্য যে আমরা কখনই বুঝতে পারিনি ওর ভিতর অনেক অভাব, অভিমান, কস্ট জমা হয়ে ছিল। খুব জোরে জোরে কথা বলত আর কেউ উলটাপালটা কিছু বললেই সাথে সাথে রেগে যেত, তাই আমরা ওকে বলতাম ৪৪০ ভোল্টের আই,সি। ওকে অনেক নামে ডাকতাম, যেমনঃ মধু, বিটা, ইঞ্জিনিয়ার, ৪২০ ভোল্ট, জাপানী আই.সি, টাইটানিক, একে ফোরটি সেভেন, আরও কত কি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বন্ধু চাদের খাতা স্যার কেড়ে নিয়েছিল,সে জন্য তুই তোর খাতা স্যার কে জমা দিয়ে বলেছিলি চাদের খাতা ফেরত না দিলে তুই পরীক্ষা দিবি না। সেই তুই কিনা এতোটা স্বার্থপর হয়ে গেলি রে বন্ধু। 
আমাকে ও ড্যাড বলে ডাকতো। আমি ডাকতাম বিটা বলে। কারন ওর দাদা আর আমার বাবা বন্ধু মানুষ ছিল তাই। আমাকে ড্যাড বলে ডাকাতে সবাই প্রথমে অবাক হয়ে যেত। ওর সাথে হাজার হাজার মধুর স্মূতি আছে আমার। ওর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বউকে আমি বউমা বলে ডাকতাম। সামনে আমাদের বন্ধন-৯৭ এর সুন্দরবন ৪ দিন ব্যাপি বিশাল ট্যুর। রাসেল ছিল প্রধান আয়োজকদের একজন। ওর শতসহস্র ব্যাস্ততার মাঝেও প্রায় ১০০ জন সদস্যদের প্রতেককে নিজে ফোন করত অংশগ্রহন কনফার্ম করার জন্য।
গতকাল সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর পথে এক ভয়াবহ রোড এক্সিডেন্টে ভালুকাতে নিজের গড়া মৎস্যখামারে যাবার পথে না ফেরার দেশে চলে গেছে সে। তার রক্তাত্ত জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমাদের বন্ধন-৯৭ এর বন্ধুদের নামের তালিকা ও ফোন নম্বর ট্যুরের যোগাযোগ করার জন্য। কি অদ্ভুত! মৃত্যুর সময়েও তার পকেটে আর মনে শুধুই বন্ধুরা। 
ও ছিল প্রচণ্ড ধার্মিক ও উচ্চশিক্ষিত। সারাক্ষন ইসলামিক বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষনা করতো। আমাদেরকেও সবসময় ধর্ম মেনে চলতে বলতো। বন্ধু, আজ তুই বেঁচে নেই, তুই হয়ত দেখছিসনা কিন্তু তোর জন্য কাদছেনা এমন কোন বন্ধু নাই। তুই সবাইকে ভালবাসা দিয়ে শুধু ঋণী করেই গেলি। তুই যে কি ছিলি আমাদের কাছে তুই নিজেও তা জানতিস না, বেটা। তুই আমাদের বুকের সবথেকে উচু জায়গায় ছিলি, আছিস, থাকবি আজীবন।
ও রাসেল, তুই কি শুনতে পারছিস বন্ধু? সেই তুই কিনা এতোটা স্বার্থপর হয়ে গেলি রে বন্ধু। তোর তুলনা তো তুই-ই। তোর সমতুল্য তো আর কেউ নাই।
রাসেল, ড্যাড আমার আর একবার আমাদের কাছে ফিরে আয়, তোকে যে আমাদের বড্ড বেশি দরকার। 
আল্লাহ তুমি আমার এই কলিজার টুকরা বন্ধুটিকে তোমার ভালবাসায় সিক্ত করে রেখো পরকালে এই ই চাওয়া তোমার কাছে মওলা.........।।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

করপোরেট দুনিয়ায় ‘জেন-জি’ কর্মী ব্যবস্থাপনা

  জেন-জিদের কর্মস্থলে কার্যকরভাবে হ্যান্ডলিং করা বা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য তাদের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং মানসিকতার দিকে নজর দিতে হব...