জেন-জিদের কর্মস্থলে কার্যকরভাবে হ্যান্ডলিং করা বা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য তাদের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং মানসিকতার দিকে নজর দিতে হবে। যেহেতু এ প্রজন্ম প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে উঠেছে, ফলে তাদের কাজের প্রতি প্রত্যাশা ও কাজ করার ধরন ভিন্ন।
জেনারেশন জেড বা জেন-জিকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এদের জুমারস, নেটজেন, টেকজেন বা নিও-ডিজিটাল নেটিভস, সাইড হ্যাসেল, ফিজিটাল জেনারেশন, ওপেন-টু-ওয়ার্ল্ড জেনারেশনও বলা হয়।
যারা ১৯৯৭-২০১২-এর মধ্যে জন্ম নিয়েছে। ২০২৪ সালের হিসেবে সবচেয়ে বড় জেড সদস্যের বয়স ২৭, আর সর্বকনিষ্ঠজনের বয়স ১২ বছর। ১৯৯৭ সালে উইন্ডজ-৯৭ কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আসে। একই সঙ্গে সিমেন্স ও নকিয়ার মতো মোবাইল ব্র্যান্ড বাজারে আসে। ১৯৯৭ সালে চালু হয় প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া সাইট সিক্স ডিগ্রি। যেখানে ব্যক্তিগত প্রোফাইল তৈরিসহ ছবি আপলোড, শেয়ার ও বন্ধুত্ব করা যেত। এরই বর্তমান রূপ এখনকার এক্স (যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল) ও ইনস্টাগ্রাম। এ প্রজন্ম স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের যুগ থেকে ফেসবুক ও ইউটিউব যুগের রূপান্তরটা দেখেছে। এদের টেক বা নেট জেন বলার কারণ এরা জন্মের পর থেকেই টেকনোলজি, ইন্টারনেট, গ্যাজেট ইত্যাদি প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে। এরা কোনো কিছু জানতে মানুষকে প্রশ্ন করার চেয়ে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে গুগল/সিরি/বিক্সবি/চ্যাটজিপিটি-কেই প্রশ্ন করতে বেশি পছন্দ করে।
এই জেনারেশনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা এখন ২৭ বছর। অর্থাৎ চাকরিতে এদের বয়স এক থেকে পাঁচ বছর। এরা গ্র্যাজুয়েশন করে ২৩-২৪ বছর বয়সে। ছাত্রাবস্থা থেকেই নিজেরা নিজের পকেট খরচ জোগাড়ের চেষ্টায় রত থাকে। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে চাকরির অভিজ্ঞতার বয়স হয়ে গেছে সাত-নয় বছর। এরা ৩০ বছর বয়সে ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক পদে নিজেকে দেখতে চায়। ৪০ বছরে নিজেকে সিইও বা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। এরা ফাস্ট ট্রাক ক্যারিয়ারে বিশ্বাসী। যতটুকু সময় পাবে যে প্রতিষ্ঠানে ততটুকু সময়েই নিজের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা ফুটিয়ে তুলতে চায়। প্রতিষ্ঠানের জন্য অল্প সময়ে বেশি ইম্প্যাক্ট নিয়ে আসতে চায়।
এদের দিয়ে একই কাজ একইভাবে অনেকদিন ধরে করালে অর্থাৎ একই পদ, পদ্ধতি বা রোলে দীর্ঘদিন রাখলে এরা কাজে আনন্দ খুজে পায় না। তখন নতুন দায়িত্বে নতুন চাকরির খোঁজ করতে থাকে। এরা ফাস্ট লার্নার; দ্রুত যেকোনো কাজ শিখে নিতে পারার এক দারুণ দক্ষতা আছে এদের ভেতর। এরা দ্রুত কাজ শিখে দ্রুত ডেলিভারি দিতে চায়। এ শেখার ক্ষেত্রে এরা কম্পিউটার, ওয়েব, এআই, গুগল, উইকিপিডিয়া, ই-লার্নিং সিস্টেম, সার্চ ইঞ্জিন, ব্লগ, ভ্লগ, ইউটিউব, বিজনেস অটোমেশন, বট টেকনোলজি, ই-কমার্স, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রফেশনাল প্লাটফর্ম, অর্গানাইজেশনাল ডাটাবেজ, ডাটা আর্কাইভ, এক্সিকিউটিভ এডুকেশন, প্রফেশনাল ট্রেনিং, আপ-স্কিলিং, রি-স্কিলিংয়ের জন্য ডিজিটাল অ্যাপস ব্যবহার করে।
জেন-জিদের কর্মস্থলে কার্যকরভাবে হ্যান্ডলিং করা বা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য তাদের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং মানসিকতার দিকে নজর দিতে হবে। যেহেতু এ প্রজন্ম প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে উঠেছে, ফলে তাদের কাজের প্রতি প্রত্যাশা ও কাজ করার ধরন ভিন্ন।
এরা কোনো বিষয় নিয়ে শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। জেন-জি সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেয়ায় অভ্যস্ত। এরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেখানে সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটিভিটি এবং উদ্ভাবনী কাজ বা ইনোভেশনের সুযোগ আছে সেখানে চাকরি করতে বেশি পছন্দ করে। এরা কাজের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক বা রক্ষণশীল স্টাইলের বদলে সরাসরি বা ডিরেক্ট কমিউনিকেশন পছন্দ করে—এটা সম্ভবত তার একটা কারণ। এরা যেকোনো কাজ একটা সিঙ্গেল ডাইমেনশনে করার থেকে বিভিন্ন ডাইমেনশনে কীভাবে দ্রুত ও ফলপ্রসূভাবে করা যায় সে চেষ্টা করে। এরা সিনিয়র বা জুনিয়র ভেদাভেদ কম করে কাজের ক্ষেত্রে। বসের কাছে নিজের মতামত মুখোমুখি ও সরাসরি দিতেই পছন্দ করে। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা নিজেরাও বলে না, শুনতেও পছন্দ করে না।
এরা রেজাল্ট ড্রিভেন হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এদের ভেতর উদ্যোক্তা মানসিকতা থাকার কারণে যে কাজ বা চাকরিই করুক না কেন এরা দ্রুত ফলাফল প্রত্যাশী। এদের হাতে একটা লেটেস্ট ইন্টেল কোরের ল্যাপটপ তুলে দিয়ে ডাটা সম্পর্কিত কিছু কাজ ধরিয়ে দিন এরা আপনাকে সিম্পলি ম্যাজিক দেখিয়ে ছাড়বে।
তাদের একটা দুর্বল দিক হচ্ছে তারা একটু অস্থির প্রকৃতির। এটা আসলে এদের দোষ না। এদের জামানার দুনিয়াটাই অস্থির। তাই এদের অস্থিরতাকে নেতিবাচক চোখে না দেখে যদি একটু স্নেহ, পরামর্শ ও গাইড দিয়ে ওদের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া যায়, এরা প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পদে পরিণত হতে সময় নেবে না।
জেন-জিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে নিচের কৌশলগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে:
দ্রুত ও স্পষ্ট যোগাযোগ: এ প্রজন্ম দ্রুত ও স্পষ্টভাবে যোগাযোগ পছন্দ করে। দীর্ঘ ই-মেইল বা মিটিংয়ের চেয়ে সরাসরি বার্তা, সোশ্যাল মিডিয়া বা ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগে তারা বেশি আগ্রহী। এরা অল্প কথায় কাজের পরিকল্পনা, অগ্রগতি, আপডেট জানতে ও জানাতে চায়।
প্রযুক্তির ব্যবহার: জেন-জি প্রযুক্তিতে দক্ষ, তাই তারা চায় দ্রুত ও কার্যকর সমাধান। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ডিজিটাল টুল যেমন বিজনেস অটোমেশন, ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম, ভালো কনফিগারেশনের ল্যাপটপ, বিভিন্ন অফিশিয়াল অ্যাপস যেমন মাইক্রোসফট ৩৬০, অ্যাডবি সিগনেচার ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য সুযোগ দিতে হবে এদের ধরে রেখে প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো ফলাফল আনার জন্য।
প্রতিক্রিয়া ও স্বীকৃতি: এরা প্রায়ই কোনো কাজের বা কমিউনিকেশনের ইনস্ট্যান্ট ফিডব্যাক চায় এবং কাজের ক্ষেত্রে তাদের অবদানের স্বীকৃতি আশা করে। তাই নিয়মিত ফিডব্যাক দেয়া এবং তাদের কাজকে রিকগনাইজ করার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করা যায় এদের।
কাজের স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা: তারা নিজের কাজের মধ্যে স্বাধীনতা ও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পছন্দ করে। এরা যেহেতু আত্মনির্ভরতাকে প্রাধান্য দেয় এবং আত্মসম্মানবোধ প্রবল, তাই তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ববোধ বাড়ানো যেতে পারে। শুধু মাঝে মাঝে কাজের ক্ষেত্রে একটু টিউন করে দিলেই ভালো করবে আশা করা যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগের সুরক্ষা: এরা যেমন শারীরিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যকেও সমান গুরুত্ব দেয়। এরা চায় অফিসের সময় ও কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা ফ্লেক্সিবিলিটি। এরা চায় এদের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং আবেগকে প্রতিষ্ঠান বা সহকর্মীরা গুরুত্ব দিক। এরা শরীরচর্চার জন্য জিমে যায়, মন ভালো করার জন্য মিউজিক শোনে, মুভি দেখে নেটফ্লিক্সে।
কর্মক্ষেত্রে বিনোদনমুখর পরিবেশ সৃষ্টি: এদের অনেকেরই ল্যাপটপে কাজের সময় খুবই লো ভলিউমে মিউজিক বাজে। কাজে যাতে বিরক্তি না আসে তাই এটির মাধ্যমে তারা নিজের মনকে প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করে। এরা কর্মক্ষেত্রে লাঞ্চের ফাঁকে বা কয়েক মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিতে কমনরুমে গিয়ে খেলা দেখতে বা খবর দেখতে পছন্দ করে। এরা কাজে ফাঁকি কম দেয়, যতটুকু কাজ করে সবটুকু উজাড় করেই করতে চায়। এরা আউটিং বা টিম বিল্ডিং খুবই পছন্দ করে। সহকর্মীদের সঙ্গে দলবেঁধে খেতে যাওয়া এদের দারুণ পছন্দ। এরা সহকর্মীদের সমস্যায় বা কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। শুধু এদের মন বা মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করলেই হয়।
মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্ব: প্রতিষ্ঠানে এরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয়। এরা প্রতিষ্ঠানে বৈচিত্র্য ও সাম্যের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায় যেগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা বা করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি পালন করে এবং সাইটেইনেবল বা টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ নিয়ে কাজ করে।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ দেয়া: এরা নতুন স্কিল বা দক্ষতা শিখতে খুবই আগ্রহী এবং নিজেদের ক্যারিয়ার উন্নতির পথ খুঁজে নিতে আগ্রহী। এরা এক্সিকিউটিভ লার্নিং বা উচ্চতর ডিগ্রি নিতে চায় চাকরিরত অবস্থায়। তাদের নিয়মিত স্কিল উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কোর্স বা কর্মশালা প্রদান করে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ দিলে তারা প্রতিষ্ঠানকে আরো ভালোভাবে সাহায্য করতে পারবে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি কমিটমেন্টও বাড়বে।
কর্মক্ষেত্রভিত্তিক ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাদান উদ্যোগ: বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাজ শেখানোর সুযোগ দিলে তারা আরো দ্রুত শিখতে পারবে এবং উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে। তাই কাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রজেক্ট বা টাস্কের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলা: এরা দলবদ্ধ কাজ করতে পছন্দ করে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের পরিবেশ থাকলে কাজের মধ্যে ইতিবাচক ও উৎসাহজনক পরিবেশ তৈরি করলে তারা আরো ফলপ্রসূভাবে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে পারবে।
আর্থিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: আর্থিক নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা এমন চাকরি খোঁজে যা শুধুই ভালো বেতন দেয় না, বরং তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। যেমন ভবিষ্যৎ তহবিল, প্রফিট শেয়ার, উৎসব ভাতা, পারফরম্যান্স বোনাস, গ্র্যাচুইটি, বার্ষিক ভ্রমণ সুযোগ, ক্যারিয়ার গ্রোথ, বিভিন্ন টাইপের আইনানুগ ছুটি ইত্যাদি তাদেরকে প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন থাকতে এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য সাধ্যানুযায়ী কাজ করে ফলাফল নিয়ে আসতে উৎসাহিত করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু সীমাবদ্ধতা সব জেনারেশনেই থাকে। যেহেতু জেন-জি নিয়ে আমাদের আগামীর পরিকল্পনা করতে হবে, তাই তাদের অসাধারণ প্রতিভাগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের এসব চাহিদার দিকে নজর দিলে জেন-জি আরো বেশি উৎপাদনশীল বা প্রডাকটিভ ও সমৃদ্ধ কর্মী হয়ে উঠতে পারে এবং শুধু সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই নয়, বরং একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গোটা দেশকেই উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস।
শিবলী হুসাইন আহমদ
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ
ক্যারিয়ার পরামর্শক ও প্রশিক্ষক
বনিকবার্তা নিউজপেপার লিংকঃ
https://bonikbarta.com/editorial/RUiutqCot6Oekpk8/